সব সম্ভবের সম্ভাব্যতা
তুমি কি কখনো একটা ১ টাকার কয়েনকে টস করে কোন খেলা শুরু করতে দেখেছ? অথবা কখনো ১ টাকার কয়েনকে টস করে ক্রিকেট খেলায় কে আগে ব্যাট করবে, আর কে আগে বল করবে এটা নির্ধারণ করেছ?
আচ্ছা বলতো, একটা এক টাকার কয়েনকে টস করলে শাপলা উঠার সম্ভাবনা কত? একটু চিন্তা করে দেখো…
একটু চিন্তা করলেই আমরা কিন্তু বলে দিতে পারি, একটা ১ টাকার কয়েন টস করলে হয় মানুষের ছাপটা উঠবে, না হয় শাপলার ছাপের পিঠটা। অর্থাৎ, ফিফটি-ফিফটি চান্স বা শাপলার পিঠ উঠার সম্ভাব্যতা অর্ধেক।
আবার মনে কর, তোমার বাসার সবাই মিলে লুডু খেলতে বসলে। তুমি মাত্র লুডুর ছক্কা নেড়ে বোর্ডে ছুঁড়ে মারলে। এখন বলো তো, ছক্কার গুটি বোর্ডে পড়া মাত্রই ৫ উঠার সম্ভাবনা কত? এটাও তুমি জানো। যেহেতু ছক্কার ছয়টা পিঠ আছে, আর এই ছয়টা পিঠে ১ থেকে ৬ পর্যন্ত সংখ্যা লিখা আছে, তাই ৫ উঠার সম্ভাবনা ছয় ভাগের এক ভাগ।
এখান থেকে আমরা একটা জিনিস খেয়াল করতে পারি যে,
কোন একটি ঘটনা ঘটার সম্ভাব্যতা = অনুকূল ঘটনার ফলাফলের সংখ্যা / মোট ফলাফলের সংখ্যা
অনুকূল ঘটনার ফলাফল বলতে আমরা, একটি ঘটনার ঘটার সকল সপক্ষের ফলাফল সংখ্যাকে বুঝিয়েছি। যেমন, ছক্কার গুটিতে জোড় সংখ্যা আছে ৩ টি। সুতরাং জোড় সংখ্যা ওঠার সম্ভাব্যতা নির্ণয়ের জন্য অনুকূল ঘটনার ফলাফল ৩ টি।
অতএব, কয়েন টসের ক্ষেত্রে শাপলা উঠার সম্ভাব্যতা
= শাপলা ছাপযুক্ত পিঠের সংখ্যা / কয়েনের মোট পিঠের সংখ্যা = ১/২
ছক্কার গুটিতে ৫ উঠার সম্ভাব্যতা
= ৫ অঙ্কটি লেখা আছে এমন তলের সংখ্যা / ছক্কার মোট তলের সংখ্যা = ১/৬
অতএব সম্ভাব্যতায় যে কোন একটি ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা যাচাইয়ের আগে আমাদের তাই বের করে নিতে হয়, সেই ঘটনার ক্ষেত্রটা কত বড়(মোট সংখ্যা, ক্ষেত্রফল, পরিমাণ ইত্যাদি)। তারপর বের করতে হয়, ঘটনাটি ঘটবেই এমন ক্ষেত্রটাই বা কতটুকু (অনুকূল ঘটনাক্ষেত্রের আকার)। তারপর অনুকূল ঘটনা ক্ষেত্রকে লব আর মোট ঘটনাকে হর ধরে আমরা সম্ভাব্যতা নির্ণয় করি।
এবার একটা ভিন্ন কিছু নিয়ে চিন্তা করা যাক। মনে কর, তুমি একটি রোবট বানালে, যে গড়পড়তা প্রতি চারটি তথ্যের তিনটি সঠিক তথ্য দেয় । এখন তোমার বন্ধু সাদ তোমার বাসায় বেড়াতে এসেছে। সে তোমাকে খুঁজে না পেয়ে তুমি কোথায় আছ সেটা রোবটটাকে জিজ্ঞাসা করল। রোবটটা সাদকে প্রথমে উত্তর দিকে, তারপর পূর্ব দিকে এবং এরপর দক্ষিণে যেতে বলল। সেখানে গিয়ে সাদ তোমাকে খুঁজে পাওয়ার সম্ভাবনা কত? খেয়াল কর, সাদ কিন্তু নিশ্চিত করে বলতে পারছে না, রোবটের দেয়া তিনটি তথ্যের প্রত্যেকটি তথ্যই সঠিক কিনা। সুতরাং, আমরা আগের মত সহজ ভাবে সম্ভাবনাটা খুঁজে বের করতে পারবো না।
আমরা একটা ভিন্ন রাস্তায় সম্ভাব্যতাটা নির্ণয় করতে পারি। যেহেতু রোবটটি গড়পড়তা প্রতি চারটি তথ্যের তিনটিই সঠিক উত্তর দেয়, সুতরাং রোবটটি যখন সাদকে উত্তরে যেতে বলেছে তখন তথ্যটি সঠিক হওয়ার সম্ভাব্যতা ৩/৪, পূর্বে যাওয়ার তথ্যটিও সত্য হওয়ার সম্ভাব্যতা ৩/৪ এবং দক্ষিণে যাওয়ার তথ্যটিও সত্য হওয়ার সম্ভাব্যতা ৩/৪ ।
সুতরাং, রোবটের দিক নির্দেশনা শুনে সাদের তোমাকে খুঁজে পাবে তার সম্ভাব্যতা
= ১ম তথ্য সঠিক হওয়ার সম্ভাবনা এবং ২য় তথ্য সঠিক হওয়ার সম্ভাবনা এবং ৩য় তথ্য সঠিক হওয়ার সম্ভাবনা
= ৩/৪ * ৩/৪ * ৩/৪ = ২৭/৬৪
একটা মজার ব্যাপার কি খেয়াল করলে? এখানে আমরা প্রতিটি একক সম্ভাব্যতাকে আগে খুঁজে বের করেছি। তারপর তাদের গুণ করেছি। কিন্তু এখানে গুণ কেন করলাম? যোগ কেন করলাম না? গণিতবিদেরা এমন সব সমস্যার সমাধান করার জন্য যে কোন ঘটনাকে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী পার্থক্য করতে চেয়েছেন। এর মধ্যে দুইটি হল, স্বাধীন ঘটনা ও অধীন ঘটনা। নাম শুনেই বুঝতে পারছো, স্বাধীন ঘটনার ক্ষেত্রে দুইটি ঘটনার একটি ঘটার সম্ভাবনা অপরটি ঘটার উপর নির্ভর করে না। যেমন ধর, দুইটি এক টাকার কয়েনকে আমরা পাশাপাশি টস করলে একটায় শাপলা ওঠার সম্ভাবনা অপরটিতে শাপলা ওঠার উপর নির্ভর করে না। তাই ঘটনা দুইটি স্বাধীন।
অন্যদিকে অধীন ঘটনায় একটি ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা অপর ঘটনা ঘটার উপর নির্ভর করে। যেমন: যদি একটা বাক্সে ৪টা লাল বল আর ৩টা হলুদ বল থাকে আর তুমি বাক্স থেকে প্রথমে একটা বল তুলে নাও তাহলে সেটা লাল হওয়ার সম্ভাবনা কিন্তু, ৪/৭ । এখন বলটা যদি লাল হয় আর তুমি যদি ওই বলটা বাক্সে না রাখ তাহলে বাক্সে লাল বল হয়ে গেলো ৩ এবং মোট বলের সংখ্যা হয়ে গেলো ৬। আরো একটা বল তুলে ফেলো, নতুন বলটি লাল হওয়ার সম্ভাবনা কিন্তু ৩/৬ বা ১/২ ! খেয়াল কর, এখানে পরের বলটা লাল হওয়ার সম্ভাবনা কিন্তু প্রথম বলটা লাল হওয়ার সম্ভাবনার উপর নির্ভর করছে। তাই ঘটনা দুইটি একে অপরের অধীন বা নির্ভরশীল।
এখন যদি আমরা রোবটের সমস্যায় ফিরে যাই, তাহলে আমরা দেখতে পারব, রোবটটা তিনটা দিকনির্দেশনার একটা ভুল দিলেই সাদ তোমাকে খুঁজে পাবে না। যেহেতু প্রত্যেকটি নির্দেশনা আলাদা আলাদা ভাবে ঘটেছে, এবং আগের নির্দেশনা ও পরের নির্দেশনা সত্য হলেই কেবল সাদ তোমাকে খুঁজে পাবে তাই আমরা সম্ভাব্যতাগুলোকে গুণ করেছি! আরেকটু বাড়িয়ে বললে, পূর্বে যাওয়ার নির্দেশনা সত্য হবে যদি উত্তরে যাওয়ার নির্দেশনা সত্য হয় যা, উত্তরে যাওয়ার সম্ভাবনা সত্য হওয়ার ৩/৪ গুণ। যেহেতু উত্তরে যাওয়ার নির্দেশনা সত্য হওয়ার সম্ভাব্যতা ৩/৪, তাই পূর্বে যাওয়ার নির্দেশনা সত্য হওয়ার সম্ভাব্যতা ৩/৪ * ৩/৪ ।
আবার যদি দুই বা তার বেশি ঘটনার মধ্যে একটি ঘটনা ঘটলে অপর ঘটনা বা ঘটনাগুলো একই সাথে না ঘটে তাহলে ঘটনা দুইটি পরষ্পর বর্জনশীল। যেমন কয়েন টস করলে শাপলা উঠলে মানুষ উঠবে না। ঠিক তার উল্টোভাবে, যদি দুই বা ততোধিক ঘটনা একইসাথে ঘটতে পারে তাহলে ঘটনা দুইটি পরষ্পর অবর্জনশীল।
যেমন: ছক্কার গুটিতে একইসাথে জোড়সংখ্যা ও মৌলিক সংখ্যা ওঠার ঘটনা একটি অবর্জনশীল ঘটনা।
বলতে পারো ছক্কার গুটিতে এমন কয়টি সংখ্যা আছে যারা একই সাথে জোড় ও মৌলিক?
এতক্ষনে তুমি হয়ত বেশ কিছু ব্যাপার খেয়াল করে ফেলেছো, আমাদের যেকোন ঘটনা ঘটার সম্ভাব্যতা কিন্তু ১ এর চেয়ে বেশি নয়। আবার, আমরা এমন কোন ঘটনা দেখিনি যেটা ঘটার সম্ভাব্যতা ০। সুতরাং আমরা বলতে পারি, যেকোন একটি ঘটনা A ঘটার সম্ভাব্যতা,
P(A) > ০ এবং P(A) < ১
বা, ০ < P(A) < ১
অর্থাৎ, অসম্ভব ঘটনা ঘটার সম্ভাব্যতা ০ এবং নিশ্চিত ঘটনা ঘটার সম্ভাব্যতা ১। তাই আমরা লিখতে পারি,
০ ≤ P(A) ≤ ১
আবার ধর, তুমি তোমার স্কুলের ল্যাবে কোন একটা পরীক্ষা করে পরীক্ষণের অনেকগুলো ফলাফল A, B, C… ইত্যাদি পেলে। সুতরাং, এদের প্রত্যেকের ঘটার সম্ভাব্যতা,
P(A) + P(B) + P(C) + …….. = ১
আমরা এই ধারণাগুলো ব্যবহার করে আমাদের সমস্যাগুলো সমাধান করবো। গণিতে সম্ভাব্যতার ধারণা খুব পুরনো কোন ধারণা নয়। মাত্র ৪০০ বছর আগে এই ধারণার বিকাশ ঘটতে শুরু করে। পাশা খেলার বোর্ড থেকে গণিতের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ একটি শাখা হয়ে ওঠার গল্পটাও বেশ চমকপ্রদ! পাকা জুয়াড়ি চেভালিয়ার দ্য মেরে (Chevalier de Mere) জুয়া খেলার বোর্ডে কোন দানটি উঠলে বেশি লাভজনক হবে তা নিয়ে এন্টনি গম্বুড (Antoine Gombaud) এর সাথে ঝগড়া বাধিয়ে গণিতবিদ প্যাসকেল (Pascal) আর ফার্মার (Fermat) কাছে সমাধান চেয়ে চিঠি লিখলেন। সেখানে থেকে উৎপত্তি হয় গণিতের এই চমৎকার তত্ত্বটির। ১৮১২ সালে, ল্যাপ্লাস (Laplace) এই তত্ত্বটিকে জুয়া খেলার বোর্ড থেকে বাস্তব জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রয়োগ নিয়ে এসে আলোচনা করেন তার Théorie Analytique des Probabilités বইয়ে। এভাবেই গণিত আর বিজ্ঞানের জগতে অনেক জনপ্রিয় হয়ে উঠতে থাকে সম্ভাব্যতার ধারণা।
শেষ করার আগে চলো আরেকটু সময়ের জন্য আমরা আবার প্রথম প্রশ্নে ফিরে যাই। তোমার কি মনে আছে, আমি তোমাকে বলেছিলাম, একটা এক টাকার কয়েনকে টস করলে শাপলা উঠার সম্ভাবনা ১/২?
কিন্তু, বাস্তবে কথাটি কতটুকু সত্য? এটার মানে কি তুমি যদি একটা ১ টাকার কয়েন হাতে নিয়ে ২ বার টস করো, তাহলে একবার মানুষ আরেকবার শাপলা উঠবে? কয়েকবার নিজে করে দেখলে খেয়াল করবে, প্রতি দুইবার টসে সবসময়ই এক বার মানুষ আরেকবার শাপলা উঠছে না। তাহলে, কি আমাদের হিসাবটা ভুল? কিন্তু ভুল হলে কি আমরা সম্ভাব্যতাকে গণিতে বা বিজ্ঞানে এত ব্যবহার করতে পারতাম?
নিশ্চয়ই ১ টাকার কয়েনে ১ উঠার সম্ভাব্যতা ১/২ হওয়ার ব্যাপারটা সত্য হওয়ার পিছনে আরও কিছু যুক্তি দিয়ে সুন্দরভাবে দেখানো যেতে পারে। সেটা কি, চিন্তা করে বের করতে পারবে?
সম্ভাব্যতার গভীর চিন্তাটা আসলে এখান থেকেই শুরু হয়।
সেই চিন্তার জগতে তোমাকে স্বাগতম!
(এ ধরণের আরো আর্টিকেল পড়ার জন্য এখানে ক্লিক করুন।)
লেখক: আহমেদ শাহরিয়ার শুভ (মেইল: shahriar@matholympiad.org.bd)