ছোটবেলায় বার্ষিক পরীক্ষা শেষ হলেই নানার বাড়িতে বেড়াতে যেতাম। সারাবছর এই সময়ের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতাম, কারণ বেড়াতে গেলেই মামাদের সাথে এদিক-সেদিক ঘুরে বেড়ানো যেতো, কারো কোন বকুনি খেতে হতো না। ছোট মামা ছিলো বুদ্ধির ঢেঁকি। প্রতিবার গেলে কঠিন কঠিন সব বুদ্ধির প্রশ্ন করতো, আর তার উত্তর নিয়ে ভাবতে ভাবতে আমাদের দিন পেরিয়ে রাত নেমে যেতো। উত্তর দিতে পারলে অবশ্য লাভ হতো, বিজয়ীর বেশে ছোট মামার সাথে বাজারের দোকানে যেয়ে পছন্দমতো জিনিস কেনা যেতো (অবশ্য না পারলেও কেনাকাটা হতো, তখন কম হতো আরকি!)। এজন্য আমরা ছোটরা সবাই আমাদের প্রিয় মামার পেছনে ঘুরঘুর করতাম, তার প্রশ্নের উত্তর দেয়ার জন্য জীবন দিয়ে চেষ্টা করতাম।
একবার ছোট মামা বাড়িতে একটি লকার নিয়ে আসলেন, নাম দিলেন ‘জাদুর লকার’। অদ্ভুত সে লকার, মামার দেয়া একটি ‘গোপন সংখ্যা’ ছাড়া নাকি সেটা খুলবে না। আমাদের বিস্ময়ের কোন শেষ নেই, এমন লকারও বুঝি পৃথিবীতে আছে! ছোট মামা লকারের ‘গোপন সংখ্যা’ বের করার জন্য পুরষ্কার ঘোষণা করলেন। এজন্য তিনি আমাদের কিছু তথ্য দিলেন যাতে আমরা মাথা খাটিয়ে সেটা বের করতে পারি। ছোট মামার তথ্য ছিলো এরকম, ‘লকারের গোপন সংখ্যা বা পাসওয়ার্ড তিন অঙ্কের একটি সংখ্যা যার সবগুলো অঙ্কই বিজোড়। গোপন সংখ্যায় 7 অঙ্কটি নেই, এবং কোন অঙ্কই একবারের বেশি ব্যবহৃত হয়নি। অঙ্কগুলো কোন ক্রমে আছে তাও অজানা।’
তাহলে, এই লকারের গোপন সংখ্যা আমরা কিভাবে বের করবো?
তাও আবার লকারেই সেটা চেষ্টা না করে?
অঙ্ক করে কি এটা বের করা সম্ভব??
প্রথমে আমরা বের করার চেষ্টা করি, চারটি বিজোড় অঙ্ক দিয়ে (1, 3, 5 ও 9) তিন অঙ্কের কোন কোন সংখ্যা পাওয়া যায়। এখানে মোট 24টি ভিন্ন ভিন্ন তিন অঙ্কের সংখ্যা পাওয়া সম্ভব। যেমন:
{135, 139, 153, 159, 193, …. 913, 931, 953}
যদিও মোট 24টি ভিন্ন সংখ্যা আমরা পেয়েছি, এবং এদের সবগুলোই স্বার্থক তিন অঙ্কের সংখ্যা, কিন্তু এদের একটিমাত্র সংখ্যা দিয়েই লকারটি খুলবে। বাকি 23টি সংখ্যা ভুল হিসেবে গণ্য হবে কারণ গোপন সংখ্যার ক্ষেত্রে ক্রম খুবই গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। যেমন: লকারের গোপন সংখ্যাটি যদি 319 হয়, তাহলে এককের স্থানে 9 কেই বসাতে হবে, 3 কিংবা 5 বসালে লকার খুলবে না। যদি আমাদের লকারে কোন ক্রমের শর্ত না থাকতো, নির্দিষ্ট তিনটি অঙ্ক জানলেই লকারটি খোলা যেতো, তাহলে উপরের 24টি সংখ্যার যে কোনটি দিয়েই কিন্তু লকারটি খুলে যেতো। একটা জিনিস তাহলে আমাদের কাছে পরিষ্কার: এ ধরণের সমস্যা সমাধানে ক্রমের শর্ত ‘থাকা’ কিংবা ‘না থাকা’ উভয়টিই খুব গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার।
ক্রমের শর্তের উপর ভিত্তি করে সংখ্যা বা অন্য যে কোনো জিনিস কত উপায়ে সাজানো যায়, কতভাবে তৈরি করা যায়, এমনকি কতভাবে বাদ দেয়া যায় ইত্যাদি জিনিস গণিতের কিছু সুন্দর ধারণা ব্যবহার করে সমাধান করা যায়। এদের একটি হলো ‘বিন্যাস’ (Permutation), আরেকটি হলো ‘সমাবেশ’ (Combination)।
উপরে দেয়া চারটি অঙ্ক ব্যবহার করে (যেখানে প্রত্যেকটি একবার করে ব্যবহৃত হয়েছে) আমরা সম্ভাব্য চব্বিশটি ভিন্ন তিন অঙ্কের সংখ্যা পেয়েছি। এখানে ক্রম গুরুত্বপূর্ণ ছিলো, অর্থাৎ আগে বা পরে কোন অঙ্কটি বসবে সেটা গুরুত্বপূর্ণ ছিলো। এ ধরণের ঘটনাকে আমরা বলবো ‘বিন্যাস’। অপরদিকে, যদি ক্রমের শর্ত গুরুত্বপূর্ণ না হতো, নির্দিষ্ট তিনটি অঙ্ক যেভাবে ইচ্ছা বসিয়ে তিন অঙ্কের একটা সংখ্যা হলেই আমাদের উদ্দেশ্য পূর্ণ হতো, এমন ঘটনাকে আমরা বলবো ‘সমাবেশ’।
গাণিতিকভাবে আমরা আরেকটু বুঝার চেষ্টা করি। ধরো, তোমার কাছে r সংখ্যক বাক্স আছে যার প্রতিটিতে একটি করে বস্তু বা জিনিস রাখা যায়। তুমি যদি n সংখ্যক বল দিয়ে এই বাক্সগুলো পূর্ণ করতে চাও, তাহলে কতভাবে সেটা সম্ভব? ক্রম থাকা বা না থাকার উপর কি হিসেব নির্ভর করবে? চলো আমরা কিছু হিসেব-নিকেশ করার চেষ্টা করি─
প্রথম বাক্স বল দ্বারা পূর্ণ করার উপায় হবে: n টি
দ্বিতীয় বাক্স বল দ্বারা পূর্ণ করার উপায় হবে: n – 1 টি
তৃতীয় বাক্স বল দ্বারা পূর্ণ করার উপায় হবে: n – 2 টি
…………………………………………………………………………
r তম বক্স বল দ্বারা পূর্ণ করার উপায় হবে: [n – (r – 1)] টি
তাহলে, n সংখ্যক বল দ্বারা r সংখ্যক বাক্স পূর্ণ করার (যেখানে ক্রম গুরুত্বপূর্ণ, প্রত্যেকটি বল একবারই নেয়া হবে, 0 < r <= n) মোট উপায় হবে─
n * (n – 1) * (n – 2) * (n – 3) … … …(n – r + 1)
বা, P(n, r) = n * (n – 1) * (n – 2) … … …(n – r + 1)
বা, nPr = n! / (n – r)!
(এখানে, n! = n * (n – 1) * (n – 2) … … … 3 * 2 * 1)। P(n, r) কে আরেকভাবে লিখার উপায় হলো nPr, দুইটি টার্ম একই উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয়)
অর্থাৎ, বিন্যাসের ক্ষেত্রে আমরা লিখতে পারি─
nPr = n! / (n – r)!
অপরদিকে, সমাবেশের ক্ষেত্রে ‘ক্রম’ গুরুত্বপূর্ণ না। কাজেই, উপরের উদাহরণের ক্ষেত্রে সমাবেশ সংখ্যা হবে (প্রতিটি বল একবার করেই নেয়া হবে)─
C(n, r) বা nCr = n! / [ (n – r)!* r! ]
এখানে কেন r! দিয়ে ভাগ দেয়া হলো? বিন্যাস ও সমাবেশের মধ্যে কি তাহলে কোন সম্পর্ক আছে? থাকলে সেটা কিভাবে বের করা যাবে?
বিন্যাস ও সমাবেশ সংক্রান্ত তত্ত্বীয় আলোচনা এবং গাণিতিক সমস্যা আমাদের দেশে কলেজ পর্যায়ে পড়ানো হয়। কেউ আরো জানতে চাইলে এই লিঙ্কে গিয়ে বিস্তারিত পড়া যাবে।
ভালো কথা, ছোট মামার লকারের গল্পটা তো শেষ হয়নি। এতোক্ষেণে বুঝে গেছো যে, ‘গোপন সংখ্যা’ নিশ্চিত হওয়ার জন্য ছোট মামার দেয়া তথ্য যথেষ্ট ছিলো না। আমাদের প্রবল উৎসাহ দেখে ছোট মামা শেষ একটা তথ্য গানের সুরে সুরে দিলেন─
‘এককের ঘরে অঙ্ক যে আছে রে,
তার উৎপাদকদের পাইবে তুমি অন্য দুটি ঘরে,
সবচে ছোটজন থাকিবে সবার শুরুতে,
সংখ্যাটি কি হবে তা বলিতে কি পারিবে?’
আমি সাথে সাথেই চিৎকার দিয়ে গোপন সংখ্যাটি বলে দিলাম। তুমি কি বলতে পারবে সেটা কত ছিলো?
হ্যাপি প্রব্লেম সলভিং!!
(প্রব্লেম সলভিং সক্রান্ত নতুন আর্টিকেল পড়োতে চাইলে এই লিঙ্কে ক্লিক করুন।)
লেখক: মাহ্তাব হোসাইন (মেইল: mahtabhossain1893@gmail.com)